রেলের অবৈধ বস্তিতে বিদ্যুৎ-পানি চুরির মহোৎসব,দেশের রাজস্ব ক্ষতি ১০ কোটি টাকা

Passenger Voice    |    ১০:৫৮ এএম, ২০২০-১১-০৩


রেলের অবৈধ বস্তিতে বিদ্যুৎ-পানি চুরির মহোৎসব,দেশের রাজস্ব ক্ষতি ১০ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিদেকঃ ৯ শীর্ষ চাঁদাবাজ ও ৩০ দখলদারের নিয়ন্ত্রনে থাকা চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলীর মাস্টার লেন এলাকায় ঝিল পাড়ে অবৈধ বস্তি তৈরি করে গত ১০ বছরে রেলের প্রায় ১০ কোটি ৩৩ লাখ টাকার বিদ্যুৎ ও পানি আত্মসাৎ করেছে চক্রটি। বাংলাদেশ রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ফয়েজলেকে অবস্থিত রেলের ওয়াটার বেড এর কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে দীর্ঘ দিন ধরে এমন অপকর্ম চালিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক প্যাসেঞ্জার ভয়েস অবৈধ বস্তিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে।

সরেজমিন প্রতিবেদনে দেখা যায় দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে একটি চক্র ঝিল পাড় এলাকায় প্রায় ৭০০ ঘর নিমার্ণ করে অবৈধ বস্তি তৈরি করেছে। রেলের জায়গা দীর্ঘ সময় ধরে এভাবে দখল করে রাখলেও রেলের কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এবিষয়ে কোন ধরনের স্বচ্ছ পদক্ষেপ নেয়নি। এই এলাকায় কি পরিমান বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহার হয় এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সামারি তৈরি করেছে প্যাসেঞ্জার ভয়েস। 

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী পরিচালক খন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে দাবী করছেন, একটি ছোট পরিবারে ৪টি বিদ্যুৎ বাল্ব, ২টি ফ্যান, একটি ফ্রিজ ও ১ টি টিভি ব্যবহার হয়ে থাকে । এই সব পরিবারে প্রতিদিন দৈনিক গড়ে ৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়ে থাকে। মাসে প্রায় ১৫০ ইউনিট। যার বাজারমূল প্রতি ইউনিট ৫.৭২ হিসেবে ৮৫৮ টাকা। 

অনুসন্ধান বলছে, প্রতি পরিবার যদি ৮৫৮ টাকার বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকে তাহলে ৭০০ পরিবারে প্রতিমাসে ৬ লাখ ৬ শত টাকার বিদ্যুৎ ব্যবহার করে , যা বছরে ৭২ লাখ ৭ হাজার ২ শত টাকা। নগরীর মাস্টার লেন এলাকায় ঝিলের পাড়ে ১০ বছর ধরে চলমান এই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার।

আইনে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবহার নিষেধ ও শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও কতেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গত ১০ বছরে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। আবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও এই অবৈধ বস্তিতে কয়েকটি বিদ্যুতের মিটার সংযোজন করেছে।  

বিদ্যুৎ আইনের ৩২ নং ধারায় বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি বাসগৃহ বা কোন স্থানে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎ চুরি করিলে অনধিক ৩ বছরের কারাদন্ড অথবা চুরিকৃত মূল্যের দ্বিগুন অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন। আইনের ব্যবহার না থাকায় এমন কঠিন আইন থাকার ফলেও কোন ভাবে এই বস্তির বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। তবে এই বস্তির লোকজন বিদ্যুতের ২টি সংযোগ ব্যবহার করে থাকে । একটি রেলওয়ের অন্যটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। দুইটি লাইন অবৈধ ভাবে সংযোগ দেওয়া আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ রেলওয়ের এমন বিদ্যুৎ সংযোগ ও বিদ্যুৎ অপচয়ে কর্মকর্তাদের দুরভিসন্ধি দেখছেন। তারা বলছে যেখানে আইনে ৩৪ নং ধারায় স্পষ্ট বলা আছে কোন ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎ অপচয় করিলে অনুন্য ১ বছর অনধিক ৩ বছরের কারাদন্ড তবুও রেলে ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকতাদের ঘুম ভাঙ্গেনি এখনও।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমি আগামীকালই (আজ) সেখানে পিডিবির অভিযান পরিচালনা করবো। অবৈধ লাইন থাকলে সাথে সাথে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

এদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে জানান, চার সদস্যের একটি পরিবার খাওয়ার পানি, গোসলের পানি ও বাহ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য প্রতিদিন ১ হাজার লিটার পানি ব্যবহার করে থাকে। এই পানি গুলোর উৎপাদন খরচ হয় চট্টগ্রাম ওয়াসার ১২.৪০ টাকা। যার সাথে ১৫ শতাংশ সরকারী রাজস্ব আদায় সহ বিল আদায় করা হয়। 

অনুসন্ধান বলছে, চার সদস্যের একটি পরিবার প্রতিদিন ১২.৪০ টাকার পানি ব্যবহার করলে মাসে সর্বনিন্ম ৩৭২ টাকার পানি ব্যবহার করে থাকে । এই হিসেবে ৭০০ পরিবারের এই বস্তিতে মাসে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা, বছরে ৩১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে আনুমানিক এই বস্তিতে ৩ কোটি ১২ লাখ ৪৮ হাজার টাকার পানি ব্যবহার করা হয়েছে, এই বস্তিতে যেহেতু রেলের পানি অবৈধ ভাবে চুরি করে ব্যবহার করা হয়েছে সেহেতু পুরা টাকাটা জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে চুরি হয়েছে। 

অনুসন্ধানে আরও  জানা যায়, নগরীর ফয়েজ লেকে অবস্থিত রেলওয়ের ওয়াটার বেড থেকে চুরি করে এই বস্তিতে পানি দেওয়া হয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিভাগীয় প্রকৌশলী দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এদিকে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইনের ১৯৯৬ (১৯৯৬ সনের ৬ নং আইন) ১৮ নং ধারায় জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ ও দারিদ্র বিমোচন বিবেচনায় ভ’মির মালিকানার প্রশ্ন উপেক্ষা করে বস্তিতে পানির সংযোগ দেওয়ার অনুমতি থাকলেও বস্তির কতিপয় নেতার চাঁদাবাজী জিইয়ে রাখতে পানির কোন বৈধ সংযোগ গ্রহন করেনি। একই আইনে ২৩ নং ধারা অনুযায়ী অবৈধ সংযোগ নেওয়াকে বিধিমালা লঙ্ঘন এবং আইনের অধীনে দন্ডনীয় অপরাধ।  যদি মালিক এই বিধিমালার পরিপন্থী কোন পন্থায় সার্ভিস লাইনে হস্তক্ষেপ করে , ক্ষতি সাধন করেন, পরিবর্তন ঘটান তাহা সম্পূর্ণ অপরাধ। আইন অনুযায়ী ওয়াসার সংযোগ গ্রহণকারী বাংলাদেশ রেলওয়ে এই বিষয়ে দায়িত্ব এড়াতে পারেনা। 

তবে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান এই অনিয়মের বিষয়ে রেলওয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আহসান হাবিব কোন বিষয়ে অবগত নয় বলে প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে জানান। তবে এই কর্মকর্তার এমন বক্তব্যকে বিশ্লেষকরা বলছে এতবড় একটি অনিয়মের ঘটনা যদি তিনি না জেনে থাকেন তাহলে সেটা তাঁর দূর্বলতা ও কর্তব্যে অবহেলা। দায়িত্বশীল এইপদ গুলোতে আরো বেশি দায়িত্ববান কর্মকর্তাদের পদায়নের জন্য কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন বিশ্লেষকরা।

আরও পড়ুন >>> কাউন্সিলর হিরনের রাজত্বে বাধ সাধবে দুদক

আরও পড়ুন >>>> রেলের মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতিতে জড়িত চট্টগ্রামের সিওপিএস শাহনেওয়াজ

এদিকে চলতি বছরের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারী ঝিলের পারে অবৈধ এই বস্তি উচ্ছেদের জন্য চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে পুলিশ ফোর্স চেয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে আবারও কর্তৃপক্ষ নিরব হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা যদি এমন বস্তির বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ নিতো তাহলে যেমন রেলের জমি বেদখল হতো না তেমনই এই অবৈধ দখলের কারনে চুরি করা বিদ্যুৎ এবং পানি ব্যাবহারের মাধ্যমে সরকারের বিপুল পরিমান রাজস্ব ঘাটতি হয়ার সুযোগ তৈরি হতো না। 

রেলওয়ে ভূ-সম্পত্তি দফতরের সূত্রগুলো বলছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আওতাধীন চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাম্মণবাড়িয়ার গঙ্গাসাগর এলাকা নিয়ে রেলের চট্টগ্রাম বিভাগ। চট্টগ্রাম বিভাগে রেলের মোট ভূ-সম্পত্তির পরিমাণ ৭২৭১.৭৩ একর। যার মধ্যে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার ১৪৯.৮২ একর ভূমি অবৈধ দখলদারদের কবলে রয়েছে। এসব জায়গা রেলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী মাফিয়া চক্রের মাধ্যমে গড়ে তলা হয়েছে হাজার হাজার বস্তি। যেখানে হরহামেশাই চলছে বিদ্যুৎ ও পানি চুরির এই মহোৎসব।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক সাদেকুর রহমান প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, রেলের জমি উদ্ধারে আমাদের অভিযান চলমান আছে। আমরা পর্যায়ক্রমে এ ধরনের সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে দিবো।

আরও পড়ুন >>>>> রেলের কেনাকাটায় হরিলুট: কব্জির জোরে বহাল দুর্নীতিবাজরা

আরও পড়ুন >>>>>> অর্ধকোটি টাকার ঘুষ লেনদেন, করোনার সময়ে ৪৫ পয়েন্টসম্যান নিয়োগ রেলে

আরও পড়ুন >>>>>>> তেল চুরিতে বছরে রেলের ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা